বড় মামা এবং আমি



এক সকালে নানু বাড়িতে গিয়েছি। বাড়ি ঢুকতেই দেখি বড়মামাদের ঘরে চাপা উত্তেজনা। একটা মামাতো ভাই সব কটা দাঁত বের করে দৌড়ে আসলো, 'ভাই বড়চাচা আজ নতুন কাণ্ড করেছে!'
'সে তো বুঝতেই পারছি। ব্যাপার কী খুলে বল।'
'সকালে বড় চাচাকে আপেল খেতে দেয়া হয়েছিল। আপলে কামড় বসিয়ে যখন প্লেটে রাখলেন, দেখা গেল আপেলের উপর দাঁত আটকে আছে!' বলে ফিচ করে হেসে ও চলে গেল।
.
তখন বড়মামার অবস্থা এমনই হয়েছিল। মামাতো ভাইয়ের হাসি হাসি মুখ দেখে আমার পেছনের কথা মনে পড়ে গেল। বড়মামা সামনের ঘরে চেয়ারে বসে আছেন, আর সামনের উঠোন দিয়েও কেউ হাটতে সাহস করছেনা। প্রয়োজনে কেউ সামনে পড়লেও দ্রুত সরে যেত। মামা পেশায় ছিলেন হাইস্কুলের শিক্ষক। ফলে স্বভাবতই ধমকি ধামকি দিতেন। বাড়ির বড়রা খুব হিসেব করে মামার সাথে অল্প কথা বলতেন। আর ছোটরা ভুলেও তার সামনে পড়তো না।।শিক্ষকতা জীবনে স্কুল নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু যখন অবসর নিলেন তখন বুঝতে পারলেন তিনি একা! কেউ তার কাছে আসেনা, শ্রদ্ধায়, ভয়ে।।গোছল, খাওয়া, নামাজ, পত্রিকা, টেলিভিশন এসবে আটকে গিয়েছিল তার জীবন। বাড়ির কাউকে ডেকে কথা বলতেন না, তিনি কারো কাছে যেতেনও না। হঠাৎ তার কাছে কোনো মেহমান আসলে তার সাথে হয়ত গল্পে মাততেন।
আমি ছিলাম বাড়িতে মেহমানের মতো। ছোটবেলা থেকেই বাড়ির বাইরে থেকে পড়তাম। ছুটিতে বাড়িতে এলে নিজেকে মেহমানের মতই মনে হত। মামার সাথে দেখা করতে গেলে মামা এক কথায় দু কথায় গল্প জুড়ে দিতেন। আমি ভয়ে চুপচাপ চেয়ারের সাথে সেঁটে রইতাম। শুরুটা কখন হয়েছিল ঠিক মনে পড়েনা, একসময় আবিষ্কার করলাম বাড়িতে থাকলে মামা নিয়মিত আমার সাথে আড্ডা জুড়ে দেন। আড্ডা বলতে তিনিই বলেন, আমি কেবল চুপচাপ শুনে যাই। প্রতি সন্ধ্যায় মামা আমাকে ফোন দিয়ে ডাকেন আর তার জীবনের গল্প শুরু করেন। কতশত সে গল্প তার হিসেব নেই। আমি রোবটের মতো শুনে যাই, আর শেষ হলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। দিন যতই যাক আমি মামার সাথে স্বাভাবিক হতে পারতাম না। ফলে পুরোটা সময় আমি অস্বস্তিতে থাকতাম। কিন্তু মামা আমার সাথে গল্প করেন এটা নিয়ে আমার মধ্যে গর্ববোধ ছিল। সবাইকে বলতে ইচ্ছে হত, 'দেখ মামা আমাকে ফোন দিয়ে ডেকে গল্প করেন!'
মামার দুই ছেলের একজন ইঞ্জিনিয়ার, অন্যজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। গ্রামে মামার যথেষ্ট সম্মান। কিন্তু সেই মানুষটা যখন আমার সাথে কথা বলতেন, আমাকে গুরুত্বপূর্ণ মানুষের মতো সম্মান দেখাতেন। এবং সেভাবেই আচরণ করতেন। আপনি বলে সম্বোধন করতেন সব সময়। অন্যান্য সময় অহরহ ব্যবহার করলেও আমার সাথে কথা বলার সময় কখনওই আঞ্চলিকতা আনতেন না। এজন্য আমি মহা মুস্কিলে পড়তাম। মামার জন্য সহজ হলেও গ্রামে বসে পরিবারের একজনের সাথে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে গিয়ে আমার মনে হত যেন হেসে ফেলবো।
একসময় মামা আমার সাথে একেবারেই স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। কিন্তু আমি পাড়লাম না। চুপচাপ কেবল শুনে যাই। এজন্য মামা বিরক্ত হতেন।।বলতেন, 'আপনার মুখে কি কোন কথা নাই? আমিই তো সারাক্ষণ বলি।' এরপর আমি দু চারটা প্রশ্ন তৈরি করে নিতাম। মামা যখন থামতেন, এই প্রশ্নগুলো করে তাকে আরও কিছুক্ষণ কথা বলায় ব্যস্ত রাখতাম।
এভাবে একমাস দুইমাস কিংবা বছর নয়, কেটে গেল কয়েকটা বছর। ছুটিতে এলে ঘরে বসে বই পড়া ছাড়া কিছুই করতাম না, ফলে আমার সাথে এই আড্ডাটা আমার ভালো লাগতো। কিন্তু কতদিন? একসময় এই বিষয়ের উপর আমার বিরক্তি চলে এল। হয়ত ততদিনে আমার জীবনেও পরিবর্তন এসেছে। মামা ফোন দিলে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বিরত থাকতাম। একাকী মানুষটার ফোনের ওপাশের দীর্ঘশ্বাসটা কখনো কখনো শুনতে পেতাম। আসলে মামার গল্পও বোধহয় ফুরিয়ে গিয়েছিল। একই গল্প ঘুরেফিরে চলে আসতো বারবার। তবু মামার সামনে কখনো অমনোযোগী হতাম না। একদিন মামা বললেন, 'আপনি না বললেও বুঝতে পারি বিরক্ত হন, কিন্তু আপনি কি জানেন, আপনাকে আমি অনেক ভালোবাসি?' তখন ভালোবাসার গুরুত্বটা আমার কাছে সেভাবে ধরা পড়েনি। আমি বরং মামার থেকে মুক্তি পেলেই বাঁচতাম। কখনো কখনো কিছু একটা বুঝতে পেরে মামা বলতেন, 'আচ্ছা যান'। আমি চুপচাপ চলে আসতাম,  পেছন ফিরে তাকাতাম না।
.
অসম্ভব বলশালী মানুষটা হঠাৎ করে বিছানায় পড়ে গেলেন। মামা তখন খুব বেশী বার্ধক্যেও উপনীত হননি। বিছানায় পড়ে মামা অসহায় হলে গেলেন। আমি মামার কাছে গেলে সহজে মুক্তি পাইনা। এদিকে জীবনের নানা অভিজ্ঞতায় আমিও তখন ক্লান্ত-বিধ্বস্ত। মামার কাছে যাওয়া কমে গেল। মামাও ততদিনে কেমন নরম হয়ে গেছেন। বাড়ির অন্যান্যদের সাথে মিশতে শুরু করেছেন। তবু আমায় পেলে মামা অন্যরকম খুশি হন। আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত গলায় একে ওকে ডাকেন। বলেন, 'আপনি তো একদম আসেন না। তবে একটা সময় আসবেন যখন আমি থাকবো না। তখন খারাপ লাগবে আপনার।'
তখনো আমি ভাবতে পারতাম না মামা কখনো চলে যাবেন। একবার বড় ছুটিতে বাড়ি গিয়ে মামার সাথে দেখা করে আসলাম। এরপর আর যাওয়া হয়না। ভাবি ছুটি তো অনেক, আজ যাবো কাল যাবো। এভাবে করে এক সপ্তাহ পরে গেলাম। মামা আমার সাথে ভীষণ অভিমান করলেন। সামান্য কথা বলে চুপ করে থাকলেন। আমিও চুপচাপ বসে থেকে একসময় চলে আসলাম। তখনো মামার ব্যক্তিত্বের সামনে কথা বলার সাহস হয়নি।
এরপর মামার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটলো থাকলো। দুবার সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা দিয়ে আনা হলো। একসময় তিনি শিশুদের মত সরল হয়ে গেলেন। যারা একসময় তার ধমক খেয়ে কাঁপত তারা এখন সারাক্ষণ তার চারপাশে ঘুরঘুর করে। মামাও তাদের সাথে সহজে মিশে যান। এসব দেখে আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। আমি কখনো কখনো গিয়ে মামার একটা হাত মুঠোর মধ্যে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকি। মামা প্রশ্ন করেন, 'মৃত্যু কেমন? খুব ভয়ের? খুব কষ্টের?' আমি প্রশ্ন করি, 'মামা এসব কেন জিজ্ঞেস করছেন?' আমার ভেতরটা হুহু করে ওঠে। চোখের সামনে একজন জলজ্যান্ত মানুষকে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে দেখার অনুভূতি ব্যাখ্যা করার নয়!
.
আমি তখন রাজশাহীতে কেবল এসেছি। ছুটিতে বাড়ি গিয়ে মামার কাছে বসে আছি। মামা গল্প শুরু করে দেন। এখন আর মামার গল্পে বিরক্তি আসেনা, আমি চুপচাপ শুনে যাই। মামা গল্পের খেই হারিয়ে ফেলেন। এক গল্প থেকে ছুটে বেড়ান তার জীবনের সকল গল্পে। তবু আমি শুনে যাই, কিছু বলার সাহস করিনা। মামার এই কথার খেই হারিয়ে ফেলা নিয়ে অন্যরা কৌতুক করে, অনেক সময় ছোটরা কেউ এসে হয়ত কথার মাঝে নতুন একটা বিষয় তুলে দিয়ে যায়। সবাই মামার সাথে মিশছে, মামাও সবার সাথে মিশেছেন, কিন্তু সবচেয়ে বেশী দিন ধরে মামাকে সময় দেয়া এই আমার আর মামার সাথে স্বাভাবিক হওয়া হয়না। এমনি এক সকালে নানু বাড়িতে গিয়েছি। বাড়ি ঢুকতেই দেখি বড়মামাদের ঘরে চাপা উত্তেজনা। একটা মামাতো ভাই সব কটা দাঁত বের করে দৌড়ে আসলো, 'ভাই বড়চাচা আজ নতুন কাণ্ড করেছে!'
'সে তো বুঝতেই পারছি। ব্যাপার কী খুলে বল।'
'সকালে বড় চাচাকে আপেল খেতে দেয়া হয়েছিল। আপলে কামড় বসিয়ে যখন প্লেটে রাখলেন, দেখা গেল আপেলের উপর দাঁত আটকে আছে!' বলে ফিচ করে হেসে ও চলে গেল।
.
আমি যখন ছুটি শেষে রাজশাহী ফিরি তখন বড়মামা তার বড় মেয়ে শিউলি আপার বরিশালের বাসায় থাকেন। আম্মাকে নিয়ে আমি গিয়েছিলাম মামাকে দেখতে। মামা আম্মাকে চিনতে পারলেও আমাকে চিনতে পারেননি। আশপাশ থেকে অনেকে বললো, 'এতো অলি... আপনার অলি মামা!' তবু মামা আমায় চিনতে পারেননি। আমরা নিঃশব্দে চলে এলাম।
.
রাজশাহী আসার প্রায় দুমাস পর এক শুক্রবারের সকালে আমার বড় আপা মামার চলে যাওয়ার সংবাদ দিল। সেদিনের তারিখ ২৫ শে মার্চ। মামা আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে সেদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও আমি তাকে শেষ দেখেছিলাম এক বছর দুমাস আগে। অথচ আমার হৃদয়ে মামার ছবিটা এখনো কত জীবন্ত! মামার ফোন নাম্বারটা এখনো ফোনের মধ্যে আছে। মনে হয় যেন একটু আগেও এই নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। কিংবা হঠাৎ করে আবার আসবে। কিন্তু সত্যটা হলো, আর কখনো ফোন আসবেনা। মামা নেই। বুঝ হবার পর প্রিয় মানুষদের মধ্যে প্রথম যাকে হারাই তিনি বড় মামা।
.
পরম করুণাময়! মামাকে অনেক ভালো রেখো!
.
.
দিনলিপি
২৫ মার্চ ২০১৭
১১৮/সি, শহীর সোহরাওয়ার্দী হল, রাবি।
Nafis oli
facebook link Chttps://mbasic.facebook.com/nafis.oli?fref=nf&refid=52&_ft_=top_level_post_id.1391883274212834%3Atl_objid.1391883274212834%3Athid.100001735245447&__tn__=C

Comments